হুতিদের গুচ্ছ বোমায় ইসরায়েলিদের কপালে ভাঁজ?

মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের কেন্দ্রে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো এবং এতে গুচ্ছ বোমা ব্যবহার চলমান আঞ্চলিক সংঘাতকে উল্লেখযোগ্য, আরও উদ্বেগজনক ও নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।

গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক আগ্রাসনের শুরু থেকেই গাজাবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। হুতিদের ছোড়া একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ধেয়ে এসেছে ইসরায়েলি ভূখণ্ড ও ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট জাহাজে। গত শুক্রবারও হুতিদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে।

এমন পরিস্থিতিতে হুতিদের গুচ্ছ বোমা ব্যবহারে ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তাদের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে।

হুতিদের 'অনন্য' হামলা

অন্যান্য হামলার চেয়ে এটি ছিল বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। আয়রন ডোমের প্রতিরক্ষামূলক ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হুতি ক্ষেপণাস্ত্র 'ছিন্নভিন্ন' করে দেওয়ার দাবি করেছে ইসরায়েল। তা সত্ত্বেও, দেশটির সেনা কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন করেছে এই হামলা। এই উদ্বেগের কারণ—ক্ষেপণাস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা গেছে, এটি 'গুচ্ছ বোমা' বহন করছিল।

houthi supporters
ইয়েমেনের সানায় হুতি সমর্থকদের ফিলিস্তিনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ। ছবি:এএফপি

বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের কেন্দ্রে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো এবং এতে গুচ্ছ বোমা ব্যবহার চলমান আঞ্চলিক সংঘাতকে উল্লেখযোগ্য, আরও উদ্বেগজনক ও নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, এই উদ্যোগে সংঘাতের 'বিবর্তন' ঘটেছে। ইয়েমেনের ওই বিদ্রোহী বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে নতুন ধারণা পাওয়া গেছে।

আজ সোমবার দ্য জেরুসালেম পোস্টের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়, 'এটা শুধুই কৌশলগত পরিবর্তন নয়। এতে (ইসরায়েলের) বহিঃশত্রুর হামলা ঠেকাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ ও কূটনীতিক ভাষা, আকাশ হামলা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নকশা এবং ইরান ও এর সহযোগীদের মধ্যে সহযোগিতার ধারণা প্রভাবিত হয়েছে।'

এতদিন পর্যন্ত একক বোমা ও ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন পাঠিয়ে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে হুতিরা। গুচ্ছ বোমার ক্ষেত্রে একটি ক্ষেপণাস্ত্রই একাধিক ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় বেশি বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে। এটি ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে।

গুচ্ছ বোমা ও ওয়ারহেড কী?

বন্দুক-পিস্তলের যেমন গুলি থাকে বা কামানের যেমন গোলা থাকে (ইংরেজিতে মিউনিশন বা অ্যামিউনিশন), তেমনি ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইলে থাকে 'ওয়ারহেড'। এই ওয়ারহেড বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের পর বিস্ফোরণের মাত্রা কেমন হবে, তা নির্ভর করে কত গতিবেগে, কত দূর থেকে এসে তা আঘাত করেছে এবং এতে কোন ধরনের ওয়ারহেড আছে, তার ওপর।

নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বা পরমাণু অস্ত্র সম্বলিত ক্ষেপণাস্ত্র নিঃসন্দেহে সবচেয়ে শক্তিশালী।

cluster_3.jpg
অবিস্ফোরিত গুচ্ছ বোমা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

তবে গুচ্ছ বোমাযুক্ত ওয়ারহেডও কম বিধ্বংসী নয়।

গুচ্ছ বোমা এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে এটি একটি বড় এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে। বাড়তি প্রতিরক্ষাযুক্ত লক্ষ্যবস্তু নয়, বরং বেসামরিক অবকাঠামো ও মানুষ হত্যায় এ ধরনের বোমা বেশি ব্যবহার করা হয়।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে এ ধরনের মিউনিশনের ব্যবহারে হুমকির মাত্রা বেড়ে যায়। এগুলোকে প্রতিহত করাও বেশ ঝামেলাপূর্ণ। আঘাত হানার পর উদ্ধার কার্যক্রমও দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই বেশ কয়েকটি বোমা অবিস্ফোরিত থেকে যায়।

মাইনের মতো দীর্ঘদিন অবিস্ফোরিত থাকায় এটি বড় বিপদের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার বহু বছর পরও বেসামরিক মানুষ হুমকিতে পড়ে যেতে পারে।

প্রথাগত ওয়ারহেড থেকে এটি খানিকটা ভিন্ন। মাঝ আকাশেই গুচ্ছ বোমা আলাদা হয়ে পড়ে এবং ১০-১২টা থেকে শুরু করে হাজারো ছোট ছোট বোমায় বিভাজিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে 'ফ্র্যাগমেন্টেশন' বলা হয়।

গুচ্ছ বোমার বিরুদ্ধে অসহায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

ইসরায়েলের অ্যারো বা ডেভিড'স স্লিং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এ ধরনের হামলা ঠেকাতে অপেক্ষাকৃত কম উপযোগী। কারণ এগুলো বড় ও একক ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমা ঠেকাতে পারদর্শী।

তবে ছোট ছোট ভাগ হয়ে যাওয়া ক্ষেপণাস্ত্রের গতিবিধি বোঝার আগেই এগুলো লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে।

davids_sling.jpg
ইসরায়েলের ডেভিল'স স্লিং প্রতিরক্ষা ব্যবস্তা। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

হুতিদের ছোড়া ক্লাস্টার ক্ষেপণাস্ত্রটি তেল আবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের কাছে পড়ে।

হামলায় সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হলেও শহরাঞ্চলে এ ধরনের হামলা অনেক ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনতে পারে। তাই ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

ইরানের কাছ থেকে পাওয়া প্রযুক্তি?

ইরানের কাছে বেশ কয়েক ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে। এর মধ্যে 'কাদের' ও 'খোরামশাহের' অন্যতম। এগুলো গুচ্ছ বোমা বহন করতে পারে। ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানকে এসব ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

হুতিরা ইরানের কাছ থেকে এই প্রযুক্তি পেয়েছে বলেই বিশ্লেষকরা মত দেন।

হুতিরা ইতোমধ্যে জানিয়েছে, গত শুক্রবারের হামলার লক্ষ্য ছিল বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরের ক্ষতি করা।

cluster_bomb.jpg
যুক্তরাজ্যে নির্মিত গুচ্ছ বোমা। ফাইল ছবি: রয়টার্স

এর আগেও বেশ কয়েকবার ইয়েমেনের সশস্ত্র সংগঠনটি একই লক্ষ্যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলি বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের কেন্দ্রস্থলে হুতির এসব হামলা 'মনস্তাত্ত্বিক' যুদ্ধের অংশ। এ ধরনের হামলার মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা, প্রভাব ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা প্রকাশ পেলেও এর নেপথ্যের মূল উদ্দেশ্য অন্যান্য দেশের উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোকে তেল আবিবে ফ্লাইট চলাচল বন্ধে বাধ্য করা।

তারা আরও মনে করেন—ইরানের নীতি হলো, তারা নতুন অস্ত্র বানালে তা প্রথমে হামাস, হুতি বা হিজবুল্লাহর মতো সহযোগীদের দিয়ে পরীক্ষা করা।

জেরুসালেম পোস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরানের বড় লক্ষ্য বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চল থেকে সহযোগী ও মিত্রদের মাধ্যমে হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করা। এসব দেশের মধ্যে আছে গাজা, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন।

এই বিদ্যমান 'মাথা ব্যথার' সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে গুচ্ছ বোমাযুক্ত দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।

এটাকে ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞরা 'নতুন ধারার হুমকি' হিসেবে আশঙ্কা করছেন। এর মোকাবিলায় সরকারকে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন।

গত শুক্রবারের হামলার পর গতকাল ইয়েমেনে ১০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান দিয়ে ৩৫টি বোমা নিক্ষেপ করে ইসরায়েল। এতে ছয় জন নিহত ও ৮৬ জন নিহত হন।

গুচ্ছ বোমার দীর্ঘমেয়াদী হুমকি

ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষই গুচ্ছ বোমা ব্যবহার করে বিতর্কে জড়িয়েছে। চলতি মাসেই রাশিয়া অধিকৃত দনেৎস্ক প্রদেশের একটি অস্ত্র ও ড্রোন বিতরণ কেন্দ্রে গুচ্ছ বোমাযুক্ত হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র 'ইসকান্দার' ব্যবহার করে হামলা চালায়। পরবর্তীতে পোলতাভায় গুচ্ছ বোমা ফেলে রাশিয়া।

উভয় ক্ষেত্রেই অসংখ্য অবিস্ফোরিত বোমার টুকরো দীর্ঘমেয়াদী হুমকি সৃষ্টি করেছে।

ইউক্রেনও তুরস্কের কাছ থেকে পাওয়া গুচ্ছ বোমা ব্যবহার করে নিন্দা কুড়িয়েছে। যুদ্ধের শুরুর দিকে ব্যাপকহারে এই বোমার ব্যবহারে বেশ সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল কিয়েভ।

cluster_5.jpg
২০১৬ সালে ইয়েমেনে গুচ্ছ বোমা হামলা চালায় সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত রুশ সেনাদের অর্ধেকেরও বেশি গুচ্ছ বোমার সংস্পর্শে এসেছিলেন। অসমর্থিত সূত্র মতে, নিহত রুশ সেনার সংখ্যা প্রায় সাত লাখ।

একই ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছে ইসরায়েলও।

খুব দ্রুত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও কৌশলগত পরিকল্পনায় অগ্রগতি না আসলে ক্ষেপণাস্ত্র 'হামলা প্রতিহতের' দাবি করাটা ইসরায়েলি সেনার জন্য বিরল ঘটনায় রূপ নেবে বলে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা।