ওয়েস্টার্ন এই ১০ সিনেমা না দেখলেই নয়

মাহমুদ নেওয়াজ জয়
মাহমুদ নেওয়াজ জয়
16 August 2025, 11:45 AM
শিল্পায়িত চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনাকালের সঙ্গে সঙ্গেই ওয়েস্টার্ন ঘরানার উত্থান ঘটেছিল।

চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে স্বীকৃত ঘরানাগুলোর একটি 'ওয়েস্টার্ন'। এই ঘরনার এমন কিছু দুর্দান্ত চলচ্চিত্র আছে যেগুলো সিনেমাপ্রেমীদের জীবনে অন্তত একবার দেখা উচিত। শিল্পায়িত চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনাকালের সঙ্গে সঙ্গেই ওয়েস্টার্ন ঘরানার উত্থান ঘটেছিল, তাই ওল্ড হলিউড আর ওয়েস্টার্ন যেন হাতে হাত রেখে এগিয়েছে। এই ঘরানার বৈশিষ্ট্য—বড় মাপের নায়ক, আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে আইন ও শৃঙ্খলার রোমাঞ্চকর গল্প। তবে শুরুতে ওয়েস্টার্ন সিনেমাগুলো মূলত দেশের ইতিহাসের সৌন্দর্যমণ্ডিত, গৌরবময় এক ছবি উপস্থাপন করত।

হলিউডের গোল্ডেন এজে প্রতি বছর ডজনখানেক ওয়েস্টার্ন সিনেমা তৈরি হতো এবং ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। তবে নিউ হলিউড যুগে এসে ওয়েস্টার্নের সেই আদর্শ বন্দুকবাজ কাউবয় চিত্রায়নে পরিবর্তন আসে। দর্শকদের রুচিতেও পরিবর্তন দেখা দেয়। তবু কিছু ওয়েস্টার্ন রয়েছে, যেগুলো সময়ের পরীক্ষায় টিকে গেছে—এবং যেকোনো দর্শকেরই দেখা উচিত।

Western Film
ছবি: ইউনাইটেড আর্টিস্টস

১. দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি (১৯৬৬)

সার্জিও লিওনের ডলারস ট্রিলজির তৃতীয় ছবি 'দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি' পুরো স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন ঘরানার শ্রেষ্ঠত্ব। ক্লিন্ট ইস্টউড আবার হাজির হন 'দ্য ম্যান উইথ নো নেম' রূপে। তার গাম্ভীর্যপূর্ণ, রূঢ় কিন্তু চিত্তাকর্ষক অ্যান্টি-হিরো এক নতুন অ্যাকশন নায়কের মানদণ্ড তৈরি করে দেয়।

এই সিনেমাটি আমেরিকান ওয়েস্টার্নের চেয়ে অনেক বেশি সহিংসতা দেখানোর সাহস দেখায়।

লিওনে ক্যামেরা ব্যবহার করেন এক ব্যতিক্রমধর্মী ভঙ্গিতে। দীর্ঘ শটের মাধ্যমে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়ে দৃশ্যকে বিস্তৃত করেন তিনি। এনিও মরিকোনের সংগীত চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত সাউন্ডট্র্যাক। সিনেমার অনেক দৃশ্যই আজ চিরন্তন হয়ে গেছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।

Western Film
ছবি: ওয়ার্নার ব্রোস

২. দ্য ট্রেজার অব দ্য সিয়েরা মাদ্রে (১৯৪৮)

মহান পরিচালক জন হিউস্টনের সিনেমা এটি। এই সিনেমার বড় শক্তি হলো লোভ এবং তার ধ্বংসাত্মক শক্তিকে নিয়ে চিরন্তন মানবিক বিশ্লেষণ। চরিত্র ডবসের (হাম্পফ্রি বোগার্ট) পতনের কারণ তার লোভ; সে এতটাই ভয়ে থাকে যে অন্যরা তার অংশ নিয়ে নেবে, যে নিজেই তাদের অংশ নেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এক টেক্সান কোডি দলে যোগ দিতে চাইলে, তারা সিদ্ধান্ত নেয় তাকে হত্যা করবে।

এই ছবিটি স্রেফ কোনো গড়পড়তা ওয়েস্টার্ন নয়; এটি মানুষের স্বভাবের গভীর বিশ্লেষণ। আর শেষ দৃশ্যটি—এক নিষ্ঠুর, তীক্ষ্ণ পরিহাস—চলচ্চিত্র ইতিহাসের সেরা সমাপ্তিগুলোর একটি।

স্ট্যানলি কুবরিক, স্পাইক লি, স্যাম রাইমি এবং পল টমাস অ্যান্ডারসন সবাই এই সিনেমাটিকে তাদের প্রিয়দের তালিকায় রেখেছেন।

Western Film
ছবি: প্যারামাউন্ট পিকচার্স

৩. ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট (১৯৬৮)

ষাটের দশকে স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন ঘরানায় নতুন জীবন আসে, আর সেই ঘরানার সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিচালক ছিলেন সার্জিও লিওনে। তার এই ছবি একটি মহাকাব্যিক বর্ণনার মাধ্যমে ক্লাসিক ওয়েস্টার্নের সব চেনা উপাদানকে একত্রিত করে। তবে যে বিষয়টি এটিকে আলাদা করে তোলে, তা হলো আকর্ষণীয় চিত্রনাট্য আর গতিশীল ক্যামেরা।

এনিও মরিকোনের অনবদ্য সংগীত এই ছবিকে এক চূড়ান্ত ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতায় রূপ দেয়। ছবির কিছু কাট ১৭০ মিনিটের বেশি সময় ধরে চলে এবং লিওনে ইচ্ছাকৃতভাবে ঘরানার গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছেন।

Western Film
ছবি: ওয়ার্নার ব্রোস

৪. আনফরগিভেন (১৯৯২)

বহু বছর ধরে ওয়েস্টার্ন ঘরানা যখন আত্মসমালোচনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী পথে হাঁটছিল, তখন ১৯৯২ সালের 'আনফরগিভেন' এক ধাক্কায় পুরোনো আমলের ওয়েস্টার্নে ফেরত নিয়ে আসে। ক্লিন্ট ইস্টউড পরিচালিত এই ছবিটি আধুনিক হলেও গল্প বলার ধরনে রয়েছে এক ধরনের সরলতা। দর্শক যেসব উপাদান ওয়েস্টার্নে খুঁজে পান, তার বেশিরভাগই এখানে আছে—তবে তার পাশাপাশি রয়েছে বয়স, সময়ের পরিক্রমা এবং আমেরিকার বন্য পশ্চিমের পতনের ভাবনাও।

ইস্টউড ছবির নায়ক ও পরিচালক—উভয় ভূমিকায়। এই সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো তার নির্দেশনা। বন্দুকযুদ্ধ ও বাইরের চাকচিক্য আসলে চরিত্রগুলোর গভীর দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে৷

Western Film
ছবি: ইউনাইটেড আর্টিস্টস

৫. ফর অ্যা ফিউ ডলার্স মোর (১৯৬৫)

ডলার্স ট্রিলজির দ্বিতীয় কিস্তি 'ফর অ্যা ফিউ ডলার্স মোর' শুরু থেকেই তার নিজস্ব স্টাইল নিয়ে হাজির হয়। প্রথম দৃশ্যেই দূরে থাকা এক ব্যক্তিকে ঘোড়া থেকে গুলি করে ফেলে দেওয়া হয়—এ যেন এক স্টাইলিশ সূচনা। তারপরই আসে এক বিখ্যাত উক্তি—'হোয়্যার লাইফ হ্যাড নো ভ্যালু, ডেথ, সামটাইমস, হ্যাড ইটস প্রাইস। দ্যাট ইজ হোয়াই দ্য বাউন্টি কিলার্স অ্যাপিয়ার্ড।'

এই উক্তি দিয়েই বোঝা যায় যে এটি শুধু আরেকটি ওয়েস্টার্ন নয়—এটি এক দর্শনও।

এনিও মরিকোন আবারও অসাধারণ সংগীত নিয়ে হাজির, যা শুরুতেই উচ্চ-প্রত্যাশা তৈরি করে।

সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং আবেগঘন অংশ অবশ্যই শেষ দৃশ্য, যেমনটা ওয়েস্টার্নে প্রায়শই দেখা যায়। এখানে কর্নেল মর্টিমার আর 'ম্যান উইথ নো নেম' (যাকে ডাকা হয় 'মানকো' নামে) একজোট হয়ে লড়েন এক ডজনেরও বেশি সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে—আর তা দেখা একেবারেই তৃপ্তিদায়ক।

Western Film
ছবি: ইউনাইটেড আর্টিস্টস

৬. হাই নুন (১৯৫২)

ওয়েস্টার্নের স্বর্ণযুগে নির্মিত ১৯৫২ সালের 'হাই নুন' ছিল প্রথম দিককার ছবিগুলোর একটি, যা ওয়েস্টার্ন ঘরানাকে ব্যবহার করে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে গিয়েছিল।

গ্যারি কুপার অভিনীত এই সিনেমায় একজন ছোট শহরের শেরিফকে ঘিরে ওঠে সাহস, কর্তব্যবোধ এবং পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন। একদল প্রতিশোধপরায়ণ বন্দুকবাজ আসছে—আর তিনি কি একাই রুখবেন?

তৎকালীন সময়ে এ ছবি অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। অনেকে একে 'অ্যান্টি-আমেরিকান' বলে সমালোচনা করেছিলেন। কারণ এতে সহিংসতাকে কৌশলে নিন্দা করা হয়েছিল। তবে মূলত এটা এক অসাধারণ নির্মাণ, যেখানে সময় ব্যবহৃত হয়েছে দারুণ কৌশলে।

মূলত রিয়েল টাইমে এগোনো গল্পটি এক চরম উত্তেজনাপূর্ণ পরিণতির দিকে গড়ায়—যা অনেক উচ্চাভিলাষী ওয়েস্টার্নের চেয়েও বেশি শ্বাসরুদ্ধকর।

Western Film
ছবি: টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি-ফক্স

৭. বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড দ্য সানড্যান্স কিড (১৯৬৯)

১৯৬৯ সালের দিকে এসে ওয়েস্টার্ন ঘরানাটি পরিবর্তনের পথে ছিল। তখন আর শুধু আমেরিকার পশ্চিমকে আলোকিত দেখানোই মুখ্য ছিল না। 'বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড দ্য সানড্যান্স কিড' এমন এক সিনেমা, যা এই পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নির্মিত।

চলচ্চিত্রটি ক্লাসিক ওয়েস্টার্নের আদর্শগুলোর সঙ্গে আধুনিক চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটায়।

পল নিউম্যান আর রবার্ট রেডফোর্ডের দুর্দান্ত রসায়ন সিনেমাটিকে প্রাণবন্ত করে তোলে। যদিও প্রথম মুক্তির সময় এটি প্রশংসা পায়নি, সময়ের সঙ্গে এটি ওয়েস্টার্ন ঘরানার সবচেয়ে প্রিয় ছবিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। কারণ, এতে পৌরষদীপ্ত সাহসিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক ধরনের কাব্যিক হাস্যরস, যা তখনকার সিনেমায় দুর্লভ ছিল।

Western Film
ছবি: ইউনাইটেড আর্টিস্টস

৮. স্টেজকোচ (১৯৩৯)

জন ওয়েন সম্ভবত ওয়েস্টার্ন ঘরানার সবচেয়ে বিখ্যাত নাম, আর স্টেজকোচ ছবিটিই তাকে সর্বসাধারণের মধ্যে পরিচিত করে তোলে। তখনো তিনি বহু ওয়েস্টার্নে অভিনয় করলেও, এই রসসমৃদ্ধ ও সুনিপুণভাবে রচিত ছবিটিই তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। এটি ছিল পরিচালক জন ফোর্ডের সঙ্গে তার প্রথম কাজ। এই ঐতিহাসিক জুটি পরবর্তীতে বহু বিখ্যাত ওয়েস্টার্ন সৃষ্টি করেছে।

স্টেজকোচের আগে বেশিরভাগ ওয়েস্টার্ন ছিল সাদামাটা ও স্বল্প বাজেটনির্ভর। কিন্তু ফোর্ডের চিত্রায়ণে ওয়েস্ট ছিল বিশাল পরিসরে, বুদ্ধিদীপ্ত চরিত্রে ভরা। অন্যদিকে, জন ওয়েন ছিলেন এক চরিত্রবান অ্যান্টি-হিরো, যিনি সহানুভূতিরও দাবিদার। এই সিনেমা তার বহু বছরের পার্শ্বচরিত্র জীবনের অবসান ঘটায়।

Western Film
ছবি: ওয়ার্নার ব্রোস

৯. দ্য সার্চার্স (১৯৫৬)

ওয়েস্টার্ন ঘরানা যখন তার শীর্ষে পৌঁছে অল্পদিন পর ধস নামবে, তার ঠিক আগে 'দ্য সার্চার্স' ছবিতে আবারও জন ওয়েন হাজির হলেন, তবে ভিন্নরূপে।

এটিও ফোর্ড-ওয়েন জুটির ছবি, কিন্তু এই ছবিতে ওয়েন ছিলেন আর দশটা ছবির আত্মবিশ্বাসী নায়কের চেয়ে অনেক বেশি জটিল এক মানুষ—ইথান এডওয়ার্ডস নামের একজন, যে প্রতিশোধের নেশায় নিজের দিক হারিয়ে ফেলে।

এই ছবির শ্রেষ্ঠত্ব হলো, এটি অসাধারণ ভিজ্যুয়াল আর চিত্রনাট্যের মিশেলে এক গভীর চরিত্র-নির্ভর গল্প বলে। এডওয়ার্ডসের ডন কুইক্সোটিক যাত্রা হলো একদিকে পুরুষতান্ত্রিক সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে এক কঠিন মানসিক জগতের অন্বেষণ।

চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ বা সিনেমাটোগ্রাফি তার সময়ের তুলনায় রঙিন, বিস্তৃত আর দর্শনীয়।

Western Film
ছবি: প্যারামাউন্ট পিকচার্স

১০. দ্য ম্যান হু শট লিবার্টি ভ্যালেন্স (১৯৬২)

এই গল্পটি মূলত আইনজীবী র‍্যানসম স্টোডার্ডকে কেন্দ্র করে, যিনি আইনবিহীন শহর শিনবোনে আসেন এবং সন্ত্রাসী লিবার্টি ভ্যালেন্সের দ্বারা নির্যাতিত হন।

এক স্থানীয় খামার মালিক গোপনে তাকে রক্ষা করেন ও একসময় লিবার্টি নিহত হয়। তবে সমাজে রটে যায় যে স্টোডার্ডই তাকে হত্যা করেছে, আর সেই থেকেই জন্ম নেয় এক কিংবদন্তি।

এই সিনেমাটি বুনো পশ্চিম থেকে সভ্য সমাজে রূপান্তর, সমাজ নির্মাণে সহিংসতার ভূমিকা এবং কীভাবে ইতিহাসে কিংবদন্তি গড়ে ওঠে—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলে।

তা ছাড়া, প্রেম, প্রতিশোধ ও বীরত্বের জটিল বাস্তবতাও ছবিতে উত্থাপিত হয়।