ধূপ বকের খাবারের লড়াই

মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ
4 May 2025, 10:53 AM
UPDATED 4 May 2025, 17:25 PM
প্রায় শুকিয়ে আসা পুকুরের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা মাছ নিয়ে বকদের এই কাড়াকাড়ি।

'সভ্য' মানুষের প্রকৃতিবিনাশী সব কর্মকাণ্ড আর 'প্রয়োজনের' তাগিদ কমিয়ে আনছে জলাভূমি, কৃষিজমি। আর সীমিত জমিতে এত বিপুল পরিমাণ মানুষের অন্নের সংস্থানে উচ্চফলনশীল জাতের সব শস্য আবাদের জন্য ক্রমেই বাড়ছে রাসায়নিক সার আর কীটনাশকের দাপট। পানিতে-মাটিতে জমছে বিষ। হারাচ্ছে দেশি জাতের মাছ, উপকারী কীটপতঙ্গ।

দেশের বহুল ‍দৃশ্যমান আবাসিক পাখি ধূপ বকের প্রধান খাবার জমি-জলার এসব ছোট ছোট মাছ ও ফসলের মাঠের পোকামাকড়। কিন্তু মানবসৃষ্ট কারণের বাইরে প্রাকৃতিক কারণেও এই ধবল পাখির খাবারে টান পড়তে শুরু করেছে। কারণ গ্রীষ্মে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলে শুকিয়ে আসছে খাল-বিল-ডোবা-পুকুর।

তাই প্রায় শুকিয়ে আসা পুকুরের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা মাছ নিয়ে বকদের এই কাড়াকাড়ি।

heron_1.jpg
ছবি: আজাহার উদ্দিন/স্টার

মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা ও হানাহানি দেখে আকাশের পাখির জগতে আশ্রয় নিয়েছিলেন চিন্তক আহমদ ছফা।

মানবজীবনের সঙ্গে বিহঙ্গজীবন ও উদ্ভিদজীবনের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক নিয়ে রচিত 'পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ' উপন্যাসে এই সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক দেখিয়েছিলেন, একই গোত্রভুক্ত হয়েও খাবারের ভাগ নিতে কীভাবে দাঁড়কাকের জোট পাতিকাকদের তাড়িয়ে দেয়।

কাকের জগতেও এমন হিংস্রতা ও মাস্তানি দেখে তার উপলব্ধি ছিল—'মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা এবং হানাহানি দেখে আকাশের পাখির জগতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানেও হিংস্রতা এবং জাতিবৈরিতার প্রকোপ দেখতে পাচ্ছি।'

heron_2.jpg
ছবি: আজাহার উদ্দিন/স্টার

অবশ্য পাখির জগতে এমন হিংস্রতা দেখেও 'মানুষের কর্তব্য পালনের জন্য' একটা সময় আবার মানুষের জগতেই ফিরে এসেছিলেন আহমদ ছফা। লিখেছিলেন, 'ভাল হোক, মন্দ হোক, আনন্দের হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মতো মানুষের সমাজে মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে। মনুষ্যলীলার করুণ রঙ্গভূমিতে আমাকে নেমে আসতে হবে।'

পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ আ ন ম আমিনুর রহমান জানাচ্ছেন, ছবির এই ধূপ বক ছোট বক, সাদা বক বা ছোট কোঁরচে বক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম লিটল ইগরেট। আরডেইডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Egretta garzetta। ভারত উপমহাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশে এসব বকের দেখা মেলে।

ধূপ বকের দেহের দৈর্ঘ্য ৫৫ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার। ওজন ৩৫০ থেকে ৫৫০ গ্রাম। আকারে বেশ ছোট বকটির পুরো দেহ ধবধবে সাদা। তবে পা কালো।

আমিনুর রহমান বলছেন, প্রজনন মৌসুমে মাথার ওপর থেকে পেছন দিকে দুটি ঝুঁটির মতো পালক ঝুলে থাকে। তা ছাড়া বুক ও পিঠে কিছু সুতোপালক গজায়। চঞ্চু ও চোখের পাশের নীল-ধূসর চামড়া লালচে রং ধারণ করে। 

চোখের রঙ হয় হলুদ। মুখের সংযোগস্থল আর নিচের চঞ্চুর গোড়া হয় হলদে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রজননহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির সুতোপালক ও ঝুঁটি থাকে না। চিকন গলা, সরু কালো চঞ্চু এবং কালো পা ও হলুদ আঙুলের মাধ্যমে গো-বক থেকে সহজেই এ বককে আলাদা করা যায়।

heron_3.jpg
ছবি: আজাহার উদ্দিন/স্টার

ধূপ বকের প্রজননকাল বর্ষা অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস। এ সময় অন্যান্য জলচর পাখির সঙ্গে গাছের শাখায় সাধারণত কলোনি আকারে বাসা গড়ে তোলে। ডালপালা দিয়ে তৈরি এ বাসা দেখতে হয় অনেকটা থালার মতো।

ধূপ বক ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি, রং ফ্যাকাশে নীলাভ সবুজ। ডিম ফোটে ২১ থেকে ২৫ দিনে। স্ত্রী-পুরুষ দুটিই পালাক্রমে ডিমে তা দেয় ও ছানার যত্ন করে। ছানাগুলো ৪০ থেকে ৫০ দিনে উড়তে শেখে। তারপর বাসা ছেড়ে যায়। আয়ুষ্কাল ছয়-সাত বছর।

সম্প্রতি রাজশাহীর তানোর উপজেলার চান্দুরিয়া এলাকা থেকে খাবারের ভাগ নিতে লড়াইয়ে নামা ধূপ বকের এই ছবিগুলো তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী আজাহার উদ্দিন