হারিয়ে যাচ্ছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী টমটম

By মো. তারেক
21 February 2025, 13:34 PM
শহরের রাস্তায় টমটম খুব রাজকীয় মনে হলেও এর একটি অমানবিক দিক রয়েছে, আর তা হলো প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা।

স্থানীয়ভাবে `টমটম' নামে পরিচিত, পুরান ঢাকার বিখ্যাত শত বছরের ঐতিহ্য ঘোড়ার গাড়িগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রায় ২০০ বছর ধরে এই গাড়িগুলো নিয়মিত শহরের রাস্তায় চোখে পড়ত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। এক সময়ে বঙ্গবাজার, ফায়ার সার্ভিস হাসপাতাল, বকশিবাজার, নারিন্দা, সিদ্দিক বাজার এবং কেরানীগঞ্জ এলাকায় ৩৫ থেকে ৪০টি টমটম চলত। শুধু সদরঘাট থেকে গুলিস্তান রুটেই ৩৩টি গাড়ি চলাচল করত। তবে বাস, মাইক্রোবাস এবং রিকশার মতো আধুনিক যানবাহনের আগমনে এই ঐতিহ্যবাহী গাড়িগুলো এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।

বঙ্গবাজারের ঘোড়ার গাড়ির মালিক বাবু বলেন, 'কয়েক বছর আগেও আমাদের ৪০টি গাড়ি ছিল, কিন্তু খৈল, ছোলা এবং শস্যের দাম বাড়ায় আমরা গাড়ির সংখ্যা কমাতে বাধ্য হয়েছি। এছাড়াও চালক ও কর্মচারীদের বেতন সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়।'

টমটম
ছবি: রাশেদ সুমন

তিনি আরও জানান, অনেকেই এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ এটি বর্তমানে আর্থিকভাবে লাভজনক নয়।

এক সময় স্থানীয়রা বিভিন্ন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের জন্য ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করতেন — যেমন বিয়ে, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, ধর্মীয় শোভাযাত্রা, সিনেমার শুটিং কিংবা নির্বাচনী প্রচারণা। কনেরা পালকির পরিবর্তে এই গাড়িতে করে নতুন বাড়িতে যেতেন। তবে আজকের দিনে, টমটমের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। যদিও বৈশাখী উৎসব, বিয়ে এবং অন্যান্য উৎসবের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানে এখনও এর চাহিদা রয়েছে।

ঘোড়ার গাড়ি এই শহরে প্রথম জনপ্রিয় করেছিলেন একজন আর্মেনীয় ব্যবসায়ী, তখন এই গাড়ির নাম ছিল 'শিরকোর'। তার প্রতিষ্ঠান জি এম শিরকোর অ্যান্ড সন্স উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঘোড়ার গাড়িকে পরিবহন মাধ্যম হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে প্রচলন শুরু করে। ১৮৪৪ সালে কলকাতা রিভিউতে ঢাকার এই গাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়।

ব্যবসায়িক দিক থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একটি টমটম প্রতিদিন প্রায় ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা আয় করে, যেখানে কোচম্যান সাধারণত ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন। তবে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অত্যন্ত বেশি। ঘোড়ার খাওয়ানোর খরচ (ঘাস, ভূষি) ছাড়াও এর খুর রক্ষার জন্য নিয়মিত স্টেইনলেস স্টিলের খুর কিনতে হয়।

শহরের রাস্তায় টমটম খুব রাজকীয় মনে হলেও এর একটি অমানবিক দিক রয়েছে, আর তা হলো প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা। প্রতিটি টমটমে ৮ থেকে ১০ জন যাত্রী বহন করা হয়, এবং ঘোড়াগুলোকে প্রতিনিয়ত ভারী বোঝা ও কাদামাটির রাস্তা অতিক্রম করতে হয়। সাধারণত এক জোড়া খুর এক দিনের বেশি টেকে না, এবং প্রতিদিন খুর বদলানো ভীষণ ব্যয়বহুল—এক কেজি খুরের দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত হয়। তাই অনেক মালিক খুর পরিবর্তন বিলম্বিত করেন। এর ফলে ঘোড়াগুলো তীব্র ব্যথা সহ্য করে, সঠিকভাবে দৌড়াতে পারে না এবং কোচম্যানের চাবুকের আঘাত সহ্য করতে হয় তাদের।

বর্তমান প্রযুক্তির অগ্রগতির এই যুগে ঘোড়ার গাড়ি প্রাচীন এবং অমানবিক। বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও, এই ধরনের গাড়ির ব্যবহার এখনো কিছু জায়গায় অব্যাহত রয়েছে, যা এক নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে আসে। এই আধুনিক যুগে ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে নিরীহ প্রাণীর প্রতি এরকম অমানবিক আচরণ অব্যাহত রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম