হাটে বিক্রি হয় যে রেডিমেড ঘর

আসিয়া আফরিন চৌধুরী
আসিয়া আফরিন চৌধুরী
15 November 2023, 11:47 AM
UPDATED 15 November 2023, 18:21 PM
এই ঘরগুলো মূলত কাঠ আর টিনের তৈরি। ঘরের আশেপাশে নদী ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিলে দু-একদিনের মধ্যেই ঘরগুলো খুলে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যায়।

ঘর আবার রেডিমেড, স্থানান্তরযোগ্য হয় নাকি? একটু অবাক লাগলেও তিন যুগ আগে থেকেই কিন্তু বাংলাদেশে রয়েছে এটি। নদীভাঙনের হাত থেকে বাসস্থানকে বাঁচাতে বহনযোগ্য ঘরের চিন্তাটা শুরু। তবে এখন শুধু নদীভাঙন নয়, স্থানান্তরের সুবিধা, নান্দনিক ডিজাইন আর সাশ্রয়ের কথা ভেবে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন এ ধরনের ঘর।

এই ঘরগুলো মূলত কাঠ আর টিনের তৈরি। আশপাশে নদী ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিলে দু-একদিনের মধ্যেই ঘরগুলো খুলে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যায়। মূলত পদ্মার পাড়ে মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঠের বহনযোগ্য ঘরের দেখা মেলে।

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় এই ঘরগুলো তৈরি হয়ে থাকে। তবে এখন মুন্সীগঞ্জ সদর, টঙ্গীবাড়ী, সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারসহ রাস্তার পাশেও গড়ে উঠেছে এসব ঘর বিক্রির হাট। আগে এসব ঘর তৈরিতে সাধারণত কাঠ আর টিন ব্যবহার করা হতো। জানালা, গ্রিল বা দরজার ফ্রেমে ভেতরে ও বাইরে খুব বেশি নকশা খোদাই করা হতো না। তবে সময়ের সঙ্গে নকশায় এসেছে পরিবর্তন।

আগে ঘরগুলোকে স্থায়ী করার জন্য ব্যবহার করা হতো মিয়ানমারের লোহা কাঠ। এই কাঠগুলো পোকা যেরকম নষ্ট করতে পারে না, তেমনি পানিতেও খুব একটা নষ্ট হয় না, ভালো থাকে অনেকদিন। তবে বাংলাদেশে এখন মিয়ানমারের লোহা কাঠের অপ্রতুলতা থাকায় নাইজেরিয়া থেকে আমদানি করা হয় কাঠ। এতেও ঘর হয় বেশ মজবুত আর স্থায়ী। এ ছাড়া সেগুন, শাল, বাচালু, করই ও ওকান কাঠের ঘরের চাহিদাও রয়েছে।

Constable_Atique1.jpg
ছবি: ঘরের হাটের সৌজন্যে

আগে চারপাশে শুধু সাদা ঢেউটিন ব্যবহার করা হলেও এখন ঘরের চালে এবং নকশায় বিভিন্ন রঙিন টিন ব্যবহার করা হয়। কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি এসব ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস অনায়াসে প্রবেশ করেতে পারে। আবহাওয়ার সঙ্গে ঘর দ্রুত ঠান্ডা ও গরম হয়।

টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো একচালা, দোচালা, চৌচালা হয়ে থাকে। আর যারা একটু সামর্থ্যবান তারা বানিয়ে নেন দোতলা বা তিনতলা ঘর।

অনেক দিন ধরেই রেডিমেড ঘরের ব্যবসায় যুক্ত মতিন তালুকদার।

তিনি বলেন, 'হাটে ৩-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দামে ঘর বিক্রি হয়। আবার অনেকেই বাড়িতে কাঠমিস্ত্রি নিয়ে পছন্দমত ঘর বানিয়ে নেন। সেক্ষেত্রে খরচটা কম-বেশি হতে পারে। তবে যত খরচ মালিক করবে, ততই ঘর সুন্দর হবে।'

ঘরের স্থায়িত্বের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এই ঘরগুলো ৯০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হবে।'

Alaska-1.jpg
ছবি: ঘরের হাটের সৌজন্যে

রেডিমেড ঘর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একচালা ঘর তৈরি করতে ৫-৭ জন শ্রমিকের ৮-১০ দিন সময় লাগে। তবে শৌখিন আর কারুকার্যমণ্ডিত ঘরগুলো তৈরি করতে ৫-৭ জন ঘরামির ২০-২২ দিন সময় লাগে। ঘরগুলো হাটে বানিয়ে রাখা হয় আলগাভাবে। বিক্রি হওয়ার পর সেই ঘর খুলে নিয়ে স্থায়ীভাবে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন। আবার যে কোনো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ঘর খুলে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়।

সিরাজদিখানের চিত্রকোট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ বলেন, 'আমি নিজে এ ধরনের ঘরে সারাজীবন বাস করেছি। বাবা-মা এবং দাদা-দাদীকেও এসব ঘরে থাকতে দেখেছি। এই বাড়িগুলো শখের। চাইলেই ইট-কাঠ দিয়ে বাড়ি বানানো যায়, তবে এটি আমাদের মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যের অংশ। এই বাড়িগুলোর যে দাম বা খরচ হয়ে থাকে, সে টাকা খরচ করে চাইলেই দালান নির্মাণ করা সম্ভব, তবে এই ঘরগুলোর সুযোগ-সুবিধা দালান নির্মাণ করে পাওয়া যায় না।'

Bogura_Gunfight.jpg
ছবি: ঘরের হাটের সৌজন্যে

মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী এই দৃষ্টিনন্দন ঘরগুলো আর ওই জেলাতেই শুধু নয়, সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে গেছে। অনেক শৌখিন ব্যক্তি এই কাঠের ঘরের দিকে ঝুঁকছেন। খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সেন্টমার্টিনের অনেক রিসোর্টে কটেজ আকারে, রেস্ট্রুরেন্ট, পিকনিক স্পটে এই ঘরগুলো শোভা বাড়াচ্ছে।