পটুয়াখালীর উন্নয়নে উপেক্ষিত গ্রন্থাগার, নষ্ট হচ্ছে ৭ হাজার বই 

ইমরান মাহফুজ
ইমরান মাহফুজ
20 June 2023, 07:29 AM
UPDATED 20 June 2023, 13:52 PM
স্থানীয় পাঠকরা বলছেন, বই পিপাসুদের পাঠতৃষ্ণা মেটানোর জন্য দ্রুত লাইব্রেরীর পরিবেশ ফিরে আনা হউক। অন্যদিকে প্রশাসন বলছে, দ্রুতই লাইব্রেরিটি চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বর্তমান পটুয়াখালীর কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠে অনেক উন্নয়নের ছবি, যে ছবি 'কাশ্মীরের উন্নয়ন' বলেও চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন উন্নয়ন করেছে স্থানীয় সরকার ও পৌরসভা। অথচ জেলার প্রাণকেন্দ্রে ৬৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত পাবলিক লাইব্রেরির যে অবস্থা তা দেখে কেউ মেলাতে পারবেন না পটুয়াখালীর উন্নয়নের সঙ্গে লাইব্রেরির পরিবেশ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৬০ সালে পটুয়াখালী লঞ্চঘাটে 'পটুয়াখালী টাউন নির্মলেন্দু স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন' নামে লাইব্রেরিটি শুরু হয়। ৬-৭ বছর চলার পর ১৯৬৮ সালের দিকে জেলা মহকুমার জেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সুধী সমাজ মিলে সরকারি কলেজ রোডে নিয়ে আসেন লাইব্রেরিটি। নাম দেন পটুয়াখালী পাবলিক লাইব্রেরি। লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য দুই বছর মেয়াদি ১১জনের একটি কমিটি কাজ করে। সভাপতি থাকেন জেলা প্রশাসক, সেক্রেটারি থাকেন একজন। বাকি সদস্য সুধী সমাজ ও পাঠক থেকে নির্বাচিত হতো। আজও সেভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে এটির সুনাম বৃদ্ধি ও বাড়ে জনসম্পৃক্ততা। পৌরসভা থেকে বরাদ্ধ পায় লাইব্রেরির জায়গা। দুটি পাশাপাশি ভবনের ৫টি রুমের দোতলা ভবনের নিচতলায় গড়ে ওঠে এ লাইব্রেরি। 

1687161743999.jpg
পটুয়াখালী পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার সময় যারা যুক্ত ছিলেন, সেই নামফলক। ছবি: স্টার

সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে এটি যে লাইব্রেরি তা বাহির থেকে বুঝার উপায় নেই। নেই কোন সাইনবোর্ড কিংবা পরিচিতি। প্রবেশপথে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ময়লা ফেলছেন। সামনে খালি জায়গা আছে, উঁচুনিচু ভেজা মাটি। ৫টি রুমের একটি অংশ এনজিওকে ভাড়া দেয়া, দুটি রুম বন্ধ ও একটি মাত্র খোলা। এর মধ্যে ৫টি টেবিলে ৩টি পত্রিকা রাখা। একটি দৈনিক সংবাদ, দৈনিক সংগ্রাম ও স্থানীয় একটি কাগজ। বাকি টেবিলের ওপর পড়ে আছে ধুলাবালির স্তর। এই রুমে পাঠকের জন্য নেই কোনো আলাদা বই। 

পটুয়াখালী পাবলিক লাইব্রেরির মূল অংশ দীর্ঘদিন বন্ধ। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পুরনো পত্রিকা ও সাময়িকী।  অযত্ন-অবহেলায় ৬-৭ হাজার মূল্যবান বই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ২জন মাত্র লাইব্রেরির কর্মী। একজন বেতন পায় ২ হাজার, ঝাড়ুদার পান ১ হাজার ৫০০ টাকা। স্থানীয় পাঠকরা বলছেন, বই পিপাসুদের পাঠতৃষ্ণা মেটানোর জন্য দ্রুত লাইব্রেরীর পরিবেশ ফিরে আনা হউক। অন্যদিকে প্রশাসন বলছে, দ্রুতই লাইব্রেরিটি চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

1687161743902_0.jpg
অনেক পুরনো বই আলমিরা। 'অনুমতি ছাড়া বই ধরিবেন না'। ছবি: স্টার

লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক কাজী শামসুর রহমান বলেন, আমি দায়িত্ব পালন করছি ৩ বছর। আমার আগে ছিলেন আতিকুর রহমান। আমি চেষ্টা করছি লাইব্রেরিটি সংস্কার করে বইগুলোকে টিকিয়ে রাখতে কিন্তু একা একা তো আর পারা যায় না। সংস্কারের জন্য এই লাইব্রেরির পাঠক ও স্থানীয় সরকার সচিব আবদুল মালেক ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে নতুন ভবন করার পরিকল্পনা করেন ২০১১-২২ অর্থ বছরে। ইঞ্জিনিয়ারের মাধ্যমে সয়েল টেস্টও করেন। কিছুদিন পর তিনি স্থানান্তরিত হলে কাজটি আর আগায় না। পরে জেলা প্রশাসকও নতুন আসে কিন্তু কাজটির বিষয় অগ্রগতি হয়নি। অথচ লাইব্রেরির (গঠনতন্ত্র অনুসারে) পদাধিকার বলে সভাপতি জেলা প্রশাসক। কিছুদিন আগে পৌরসভার বর্তমান মেয়র বলেছিলেন এটা নতুন করে সাজাবেন কিন্তু আজও বাস্তবায়ন হয়নি।' 

প্রসঙ্গে পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পটুয়াখালীর অনেক কাজ করছি আমরা। এই লাইব্রেরি নিয়েও আমাদের পরিকল্পনা আছে। কিন্তু পাবলিক লাইব্রেরির এতো দুরবস্থা আমার জানা ছিল না। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। দ্রুত ব্যবস্থা নেব।

লাইব্রেরিয়ান জাকির হোসেন বলেন, '১৪-১৫ বছর ধরে আমি লাইব্রেরিটি দেখাশোনা করছি। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এটি খোলা রাখা হয়।  আগে অনেক পাঠক আসতো, এখন অনেক কমে গেছে। মূল্যবান অনেক বই নষ্ট হচ্ছে। কিছু ভালোমানের র‍্যাক হলে বইগুলো রাখা যাবে। এবং লাইব্রেরির সংস্কারকাজ করলে পরিবেশটাও সুন্দর হবে। 

355520381_811925030543090_5646402001131581189_n.jpg
পটুয়াখালী পাবলিক লাইব্রেরিতে ছিল নিজস্ব টাইপরাইটার। 'ইতিহাস ও জীবনী'র খালি আলমিরার সামনে অকেজো হয়ে আছে। ছবি: ইমরান মাহফুজ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাঠক বলেন, আমাদের চারপাশে এতো উন্নয়ন অথচ দুর্ভাগ্য লাইব্রেরি বা পাঠাগারের খোঁজ রাখার কেউ নেই। এইখানে যেটা আছে তাতে অনেক দিন মানুষের আনাগোনা নেই। কাজের বই বই বস্তায় ভরে রাখা হয়েছে। নষ্ট হচ্ছে অনেক বই। অথচ লাইব্রেরি সমাজকে আলোকিত করে। আর এই লাইব্রেরির  ১১ সদস্যের কমিটির দু-একজন ছাড়া কেউই পাঠাগারের বিষয়ে কোনো খোঁজখবর রাখে বলে মনে হয় না।'

লাইব্রেরির সভাপতি- পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মোঃ শরীফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে বিষয়টি শোনেন এবং 'মিটিং এ আছি, ব্যস্ত' বলে কেটে দেন। পরে একাধিকবার চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি। 

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ আব্দুল্লাহ সাদীদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, পাবলিক লাইব্রেরি নামে কিছু আছে তাই আমাদের জানা নেই। সেখানের কেউ কখনো যোগাযোগ করেনি। এতোগুলো বই নষ্ট হচ্ছে, বিষয়টি আমরা জানিও না, চলতি বছর জানুয়ারিতে এসেছি আমি। কেউ যোগাযোগ করলে আমরা বিষয়টি দেখব। লাইব্রেরির চালু করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।'