পেশাদার খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা

By আবীর হোসেন
7 April 2022, 12:09 PM
মাঠের ফ্লাডলাইটের ঝকঝকে আলোতে যখন সব উৎসুক চোখ আপনার ওপর এবং খেলার অন্তিম কিছু মুহূর্তে চেষ্টা করছেন শেষ একটা গোল বা একটা উইকেট দিয়ে স্কোরের দান উলটে দেওয়ার; তখন অ্যাড্রেনালিন আর খেলার প্রতি প্যাশনই আপনার পা দুটোকে পরিচালিত করবে, দৌড়াবার, নিজের সবচেয়ে ভালোটুকু দেবার শক্তি দেবে। 

মাঠের ফ্লাডলাইটের ঝকঝকে আলোতে যখন সব উৎসুক চোখ আপনার ওপর এবং খেলার অন্তিম কিছু মুহূর্তে চেষ্টা করছেন শেষ একটা গোল বা একটা উইকেট দিয়ে স্কোরের দান উলটে দেওয়ার; তখন অ্যাড্রেনালিন আর খেলার প্রতি প্যাশনই আপনার পা দুটোকে পরিচালিত করবে, দৌড়াবার, নিজের সবচেয়ে ভালোটুকু দেবার শক্তি দেবে। 

খেলোয়াড় হওয়ার এবং এই অনুভূতির ভেতর দিয়ে যাওয়ার এমন স্বপ্ন হয়তো আমাদের মধ্যে অনেকেই একবার হলেও দেখেছেন। তবে স্বপ্নটা সার্বজনীন হলেও, এই স্বপ্নে লেগে থেকে সফল হতে পারে কেবল গুটিকয়েক মানুষ। 

অবশ্য এই স্বপ্নের পথে বাধাও কম না! আমাদের সমাজ প্রতিনিয়ত খেলা এবং খেলার মতো যেকোনো 'ব্যতিক্রমী' পেশাকে বাঁকা চোখে দেখে। তাই এমন পেশাকে আপন করে নেওয়া এবং সে পেশায় শীর্ষে পৌঁছানোর স্বপ্ন যাদের থাকে, তাদের পথ বেশ মুশকিল বললেই চলে। 

১৭ বছর বয়সী ক্রিকেট একাডেমির খেলোয়াড় দাহির ফারসীম তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুর দিকটার স্মৃতিচারণ করেন, 'আমি যখন জাতীয় দলের খেলা দেখতাম, তখন কল্পনা করতাম আমিও একদিন দেশের জন্য এভাবেই খেলবো এবং দেশবাসী আমাকে নিয়ে একইভাবে গর্ববোধ করবে। একসময় এই স্বপ্নটাই প্যাশনে পরিণত হয়ে গেল এবং আমি আমার জমানো টাকা এক করে ফুলসেট ক্রিকেট গিয়ার কিনে একটা ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। 

দেশি বলারস নামের জাতীয় বাস্কেটবল গ্রুপটির সহপ্রতিষ্ঠাতা আশরিন মৃধা একইভাবে তার শুরুর দিককার সময়ের স্মৃতি তুলে ধরেন, 'আমি যখন বাস্কেটবল খেলা শুরু করেছিলাম তখন এই খেলার জাতীয় দলও ছিল না। যদিও পরে জাতীয় দল তৈরি হয় এবং আমিও তার অংশ ছিলাম। কিন্তু আসলে আমার খেলা কখনোই শুধু এই পদের জন্য ছিল না।' 

এরকম সবার শুরুর গল্পটাই ভিন্ন, একেকজন একেকভাবে খেলাকে কেন্দ্র করে তার প্যাশন বা আগ্রহ খুঁজে পায়। কেউ বা টেলিভিশনে খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হয়, কেউ আবার পাড়ার মাঠের অপরিপক্ক কিন্তু প্রাণোজ্জ্বল খেলাতেই পেয়ে যায় উদ্দীপনার খোরাক।

নেক্সট লেভেল স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট (এনএলএসএম) এবং ব্র্যাক নিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিকাল পরিচালক এবং কোচ অমিত হাসানের মতে, 'আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের যা পিছিয়ে দেয় তা হলো দেরিতে প্রশিক্ষণ শুরু করা। খেলোয়াড় হওয়ার যে ডিসিপ্লিন সেটায় নিজেকে বাঁধতে এবং খেলা সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জ্ঞান রাখতে অনেক অল্প বয়সেই ট্রেইনিং শুরু হওয়া জরুরি। আমাদের চারপাশে তাই অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকার পরেও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে তাদের প্রশিক্ষণ যথার্থ হয় না। এমনকি দেশের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলোরই যথাযথ হোমগ্রাউন্ড নেই, নিজস্ব একাডেমির কথা তো বাদই দিলাম।'

এমন সঠিক প্রশিক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধার অভাবের পাশাপাশি আছে তরুণ খেলোয়াড়দের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার চাপ। স্কুল আর কোচিং এর ধারণা দিতে দিতেই হারিয়ে যায় খেলার প্র্যাকটিস এমনকি ন্যূনতম শারীরিক কসরত করার সময়। 

দাহীর জানায়, তার জন্য সহজ ছিল না পরীক্ষার ফলে আঁচ এনে প্র্যাকটিস, ক্যাম্প, ম্যাচ খেলা চালিয়ে যাওয়া - 'ঠিক সেই কঠিন সময়টাতে আমার বাবা-মাও আমার পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তখন আমি খুবই কম সময় দিতে শুরু করি ক্রিকেটে, প্র্যাকটিসের জায়গা নিয়ে নেয় পরীক্ষা আর ম্যাচের জায়গা নিয়ে নেয় ক্লাস!'

বেশিরভাগ কিশোর বা তরুণের ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চাপ ও সে সংক্রান্ত কার্যক্রমই দখল করে নেয় দিনের সিংহভাগ সময়। ফলে নিয়মিত প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের খেলোয়াড়সুলভ শারীরিক গঠন, দম এবং পেশিও তৈরি হতে পারে না, তাই তারা আসে না কোচের নজরেও। পুরো প্রক্রিয়াটিই চক্রাকার ও ক্লান্তিকর। 

আশরিন জানান, যদি কর্মক্ষেত্রেও একটু কর্মীবান্ধব কাজের শিডিউল থাকে তাহলে চাকরিজীবীরাও সুযোগ পাবে দিনের কিছুটা সময় শরীরচর্চায় ব্যয় করার এবং সারাদিন বসে কাজ করার শারীরিক অবসাদ কাটানোর। 

গুলনাহার মাহবুব মনিকা, জাতীয় বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় এবং দেশি বলারস সংগঠনটির সহপ্রতিষ্ঠাতা। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দক্ষ খেলোয়াড় হতে হলে অবশ্যই অধ্যবসায় প্রয়োজন। প্রতিদিন প্র্যাকটিস ছাড়া একজন খেলোয়াড় বা কোচ কখনোই উন্নতি করতে পারবে না।' 

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের বয়স যত বাড়ে, আমাদের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার চাপ, ক্যারিয়ারে উপরে ওঠার চাপ, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের চাপও বাড়তে থাকে। ফলে অনেকেই পিছপা হয়ে যায় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন ও প্রশিক্ষণ থেকে।'

গুলনাহার তুলে ধরেন কীভাবে খেলোয়াড়রা একইসঙ্গে আক্রান্ত হন অর্থনৈতিক চাপ এবং সামাজিক নিন্দা ও কটূক্তিতে। একজন খেলোয়াড়ের একইসঙ্গে শারীরিক ও মানসিক ট্রেইনিং প্রয়োজন একজন বিশ্বমানের অ্যাথলিটে পরিণত হতে। তবে এসব বাহ্যিক চাপ আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের দিন দিন নিরুৎসাহিত করে এবং তাদের মনোবল ভেঙে দেয়। অভিভাবকের জন্যেও সন্তানের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে শঙ্কা প্রভাবিত করে ফলে বেশিরভাগ অভিভাবকই সন্তানকে পেশাজীবী খেলোয়াড় হতে দিতে চান না। 

আশরিনের মতে, 'নারী খেলোয়াড়রা প্রতিনিয়ত সমালোচনা, অসম আচরণ ও কটূক্তির সম্মুখীন হন সমাজ, এমনকি অনেকক্ষেত্রে নিজের পরিবার ও বন্ধুমহল থেকেও। এত রকম বাঁধার সম্মুখীন হবার পরও একমাত্র যা তাদের চালিত করে তা হলো ইচ্ছাশক্তি। একজন খেলোয়াড়ের জন্যে সর্বোচ্চ র‍্যাংক ও লেভেলে উন্নীত হওয়া লোভনীয় ও স্বপ্নের বটে কিন্তু তা কখনোই মূল লক্ষ্য নয়, মূলে সবসময়ই থাকে খেলার প্রতি তার ভালোবাসা।' 

এত কিছুর মধ্যেও অমিত আর তার দল এনএলএসএম দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে এ দেশে খেলাকেন্দ্রীক সংস্কৃতিতে কিছু বদল আনতে, 'আমরা চেষ্টা করছি নতুন ও তরুণ খেলোয়াড়দের পরিচয় করাতে বর্হিবিশ্বের নিয়মানুবর্তী একাডেমিক ট্রেইনিংয়ের সঙ্গে। আমরা খেলার ট্রেইনিংয়ের পাশাপাশি আমাদের খেলোয়াড়দের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাথলেটিক স্কলারশিপ পেতেও সাহায্য করি।'

সবার পক্ষে হয়তো নিজেকে বিশ্বমানের প্রতিযোগিতামূলক খেলার দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে কি নিজের খেলার জগতে থাকার স্বপ্নকে বলি দিতে হবে? একদমই না! এই জগতে পেশাজীবী খেলোয়াড় হওয়ার বাইরেও আছে নানা রকম পেশা। 

অমিত বলেন, 'কোচিং ব্যাজ তুলে নিন অথবা কমেন্টারির মাইক বা খুলেই ফেলুন না নিজের স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি! খেলাধুলার দুনিয়া আজ অনেকদূর বিস্তৃত।' ফ্র্যাঞ্চাইজ স্পোর্টসের জনপ্রিয়তার সঙ্গে এসেছে পর্দার সামনে ও পিছে নানা রকম সৃজনশীল কাজ করার সুযোগ।'
 
আশরিন এখানে যুক্ত করেন খেলার সেসব গুণাবলি যা পেশাদার খেলোয়াড় না হয়েও আপনি সহজেই অর্জন করতে পারবেন, 'খেলাধুলা করে শরীর আর মন তো ভালো থাকেই, সঙ্গে খেলার মাঠে পাওয়া যায় অনেক ধরনের বন্ধু। এই মাঠ থেকেই শেখা যায় নিয়মানুবর্তীতা, অধ্যাবসায় এবং টিমওয়ার্ক, এই শিক্ষা মাঠের বাইরেও জীবনের সর্বত্র কাজে দেয়।' 

গুলনাহার বলেন, 'খেলোয়াড়দের জন্য নিজেদের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি শেয়ার করতে শেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে অন্যরাও এগুলো কাজে লাগাতে পারে, যখন তারা একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাবে। সার্বিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলতে খেলোয়াড়দের মাঝে এই যোগাযোগ এবং একে অপরের অনুপ্রেরণায় পরিণত হওয়া খুবই জরুরি।'

আশরিন জোর দেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার সুযোগবৃদ্ধি এবং সব লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের সমান সুযোগ দেওয়ার উপরও। তিনি জানান, দেশি বলারসে তাদের প্রতিনিয়ত চেষ্টা থাকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের শিক্ষার পাশাপাশি খেলা ও শরীর চর্চার গুরুত্ব নিয়ে সচেতন করা। 

দাহীর এ ব্যপারে আশাবাদী যে, 'পড়শোনার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং শিল্পচর্চাকে গুরুত্ব দিলে অনেক শিশু-কিশোরকেই তার স্বপ্ন থেকে পিছপা হতে হবে না। তারুণ্য সত্যিই সমাজকে তার সেরাটা দিতে পারে যখন তাকে সময়োপযোগী সুযোগ তৈরি করে দেয়।'

সব স্বপ্নের মতই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলার স্বপ্নের সঙ্গেও জড়িত আছে অনেকটাই বিশ্বাস এবং আশা। 

অমিত হাসান বলেন, 'জীবন যে আসলে আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা বলা দুষ্কর, বিশেষত আপনার বয়স যখন মাত্র বিশের কোটায়! তাই স্বপ্নের পিছে ছুটতে থাকুন ধৈর্য ধরে। কিছু স্বপ্ন হয়তো আমাদের আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ফসকে বেরিয়ে পড়ে কিন্তু এগুলোকে পরাজয় হিসেবে দেখলে চলবে না। সফলতার সংজ্ঞাও অর্থকড়ি ও খ্যাতি দিয়ে একমাত্রিকভাবে নির্ধারণ না করাটাই শ্রেয়।'

আশরিন তার বক্তব্যের উপসংহার টানেন তরুণ খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্য করে, 'ওনেক বছর পর যখন তোমাদের পড়াশোনার পাঠ চুকে যাবে, চাকরিটাও চলে আসবে রিটায়ারমেন্টের দ্বারপ্রান্তে, তখনো  এই আক্ষেপ রেখো না যে নিজের প্রিয় খেলাটাই এ জীবনে ঠিক করে খেলার সময়-সুযোগ পেলে না!'

 

অনুবাদ করেছেন আদ্রিতা কবির