প্রথাগত সংবাদমাধ্যম কি তরুণদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে?
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বয়স ২৪ বছরের কম। জনসংখ্যার এত বড় অংশ হবার পরও, নানান কোলাহলে এদেশের তারুণ্যের আওয়াজ চাপা পড়ে যায়।
আমাদের ছোটবেলা থেকেই সব সময় গুরুজনের উপদেশ মেনে চলতে শেখানো হয়। ছোটো বলে আমাদের অভিজ্ঞতা কম, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে পারি, এমন অজুহাতে আমাদের অনেক মতামত উপেক্ষিত হয়েছে।
এক অর্থে তারা ভুল বলেননি। তারুণ্য আমাদের জেদি, একগুঁয়ে ও আবেগপ্রবণ করে তোলে। তারুণ্যের শিখা পৃথিবীকে ভস্ম করে দিতে পারে, কিংবা আলোকিত করতে পারে উজ্জ্বল আগামীর পথ। অথচ অভিজ্ঞতার অভাবে সমাজের নানা চাপের কাছে আমরা অসহায় বোধ করি। যেন এক অদৃশ্য স্রোত আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
চুপ করে থেকে এই অসহায়ত্ব দূর হবে না। নিজেদের হাতে দায়িত্ব তুলে নিয়েই কেবল এই বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।
আমাদের চারপাশে ঘটে চলা নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা এবং সেসবের খবর যে জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে তার মধ্যে কেমন একটা ফাঁক থেকে যায়। তথ্যের অনুপস্থিতি জন্ম দিচ্ছে উদাসীনতার। সেই শূন্যতা পূরণে আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সোশ্যাল মিডিয়া। মূলত সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্ম হলেও, তা এখন পরিণত হয়েছে এর চেয়েও বেশি কিছুতে।
পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন সংবাদ বা টক শোর ওপর তরুণদের আস্থা ক্রমশ কমছে। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের ব্যাপারে তরুণদের মাঝে এমন পরিবর্তনের কারণ কী?
আঠারো বছরের আস্মিতা যুরাফা রহমান জানান তার ভাবনা, 'সত্যিকারের খবরের চেয়ে আমার মায়ের যেই বন্ধু দাবি করে সে আর্সেনিক দিয়ে করোনা সারাতে পারে তার কথা বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু ফক্স নিউজে গ্রিন এমএন্ডএমের আর 'হট' না থাকা সংক্রান্ত অহেতুক খবর নিয়ে যখন তারা অভিযোগ করে, তখন বোঝা যায় কোন জায়গার খবরে বিশ্বাস করতে হবে তা বুঝতে পারাও খবর দেখারই অংশ, সে খবর আপনি যেখান থেকেই পান না কেন।'
নিত্যনতুন মাধ্যম, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরতায় এই ডিজিটাল যুগের তরুণেরা প্রথাগত সংবাদমাধ্যম বিমুখ হয়ে উঠছে। জেন-জি'র (Gen-Z) দিকেই তাকানো যাক, যারা সারাদিনে বেশ উল্লেখযোগ্য সময় কাটাচ্ছে একে অন্যের সাথে তাদের স্মার্টফোনে বিভিন্ন অ্যাপ বা সাইটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। এর ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর পেয়ে যাচ্ছে মুহূর্তেই।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মুবাশশির মুনতাহা বারী (২২) জানান কেন তিনি ভিন্ন ভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে খবর জেনে থাকেন, 'আমার ধারণা যারা পত্রপত্রিকা পড়েন তারা নিশ্চয়ই খবরগুলো আত্মস্থ করার সময় এবং শ্রম দেবেন। কিন্তু আমরা যারা তরুণ, খুব দ্রুতগতির জীবন কাটাচ্ছি, প্রতিদিন কিছুটা করে ছোটো ছোটো খবর পেলেই বেশি সুবিধা হয়। আপনি লম্বা আর্টিকেল পড়ার বদলে কেবল একটা ইনফোগ্রাফিক থেকেই একটা খবরের খুঁটিনাটি জানতে পারবেন।'
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে প্রচুর নিত্যনতুন বিতর্কও সৃষ্টি হচ্ছে। যা থেকে বোঝা যায় যে, তরুণরা সাহস পাচ্ছে সমাজের নানা দিক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অকপটে নিজেদের মতপ্রকাশ করার। কোনো অনুষ্ঠান কিংবা আন্দোলন চলাকালে খবরের চেয়ে ইন্টারনেটে ফেসবুক বা টুইটারের লাইভ আপডেটই বরং দ্রুত ছড়িয়েছে।
গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর বিকল্প হিসেবে তরুণদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এ কারণে এখনকার খবরগুলোও নির্দিষ্ট দর্শকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করতে হয়। আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে মানুষ বড্ড কম সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে, সেখানে তরুণেরা সকালবেলার পত্রিকা উল্টে দেখবে কিংবা টেলিভিশনের স্ক্রিনে আঠার মতো লেগে থাকবে- এমনটা আশা করা বৃথা।
'শুরুর দিকেই আমরা খেয়াল করি খবর উপস্থাপনে কোনোই বৈচিত্র্য নেই। পুরোনো সংবাদমাধ্যমগুলোয় আদতে কোনো সমস্যা নেই, তবু মনে হচ্ছিল কী যেন বাকি রয়ে যাচ্ছে। একটা সময় বুঝতে পারলাম, কোনো একটা ঘটনা নিয়ে এমন চটজলদি, কম কথার খবরেরই ঘাটতি ছিল', জানান ক্যাবলগ্রাম-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক তানজিল কবির।
রয়টার্সের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ইদানীং তরুণরা লম্বা লম্বা আর্টিকেলের বদলে গ্রাফিক সংবাদের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন। চটজলদি পড়া যায় বা দেখা যায়, এমন খবরের কাটতি এখন অনেক বেশি। এ যেন নানা জায়গা থেকে জড়ো করা একটুখানি গরম খবর।
'আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সোজাসাপ্টা কিছু ক্যাপশনের সঙ্গে অল্পকিছু ছবি আর মূলভাব দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলোর আদ্যোপান্ত সম্পর্কে মানুষকে একটা বিস্তারিত ধারণা দেওয়া', জানান সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক নিউজ এজেন্সি পলিগ্রাম-এর প্রতিষ্ঠাতা সৈকত সাহা।
আজকালকার দিনে তরুণরা আশা করে যেন তাদের মতামত ও জীবনের গল্পগুলো যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে খবরে উপস্থাপন করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথোপকথন এবং তর্ক-বিতর্ক কেবল সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এখানে প্রত্যেকেই একটা অলিখিত অধিকার নিয়ে নিজের কথাগুলো বলার এক সুযোগ পেয়েছে।
ঢাকা ট্রিবিউনের সাবেক ফিচার লেখক রাইসা রাশেদ মন্তব্য করেন, 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিত্যনতুন ফিচারের কল্যাণে আমরা যেভাবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কিংবা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে দ্রুতবেগে খবর ছড়াতে দেখছি, গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমগুলো অতটা সহজবোধ্যভাবে এগুলোর বৈচিত্র্য তুলে ধরতে পারেনি। ইদানীং তরুণরা ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা থেকে শুরু করে সকল ব্যাপারেই দ্বিধাহীন মতপ্রকাশ করছে, ফলে প্রথাগত মাধ্যমগুলো কিছুটা বাধ্য হচ্ছে একপেশে খবর কম প্রকাশ করার, যদিও তাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি।
গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর সঙ্গে জড়িত এই সমস্যাগুলো, সেইসঙ্গে তরুণ সমাজে এগুলোর জনপ্রিয়তা কমতে থাকা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, বিকল্প হিসেবে সমসাময়িক সংবাদমাধ্যমগুলো আসলেই কার্যকরী কিনা।
সকল জটিলতা দেখে মনে হয় সোজাসাপ্টা উত্তর হবে 'না'। গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমগুলোয় বেশ কয়েক ধাপ যাচাই-বাছাই পার হয়ে এরপর খবর প্রচার করা হয়, যা স্বভাবতই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেলায় হয় না। সত্যিকারের খবরগুলো পাওয়ার সকল উপাদান সরবরাহ করা হয় গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। তার উপর প্রথাগত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া খবরের কপিরাইট লঙ্ঘন করে তা যত্রতত্র ব্যবহারের পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে, যা বেশ উদ্বেগজনক। টাকার লোভে নৈতিকতা বর্জন করে হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগও রয়েছে বিভিন্ন ভুঁইফোড় নিউজ পোর্টালের বিরুদ্ধে। সমসাময়িক সংবাদমাধ্যম মেল্টওয়াটার-এর বিরুদ্ধে ২০১২ সালে এসোসিয়েটেড প্রেসের দায়ের করা এক মামলার কথা এখানে উদাহরণ হিসেবে টানা যেতে পারে। মামলায় তাদের কর্মপদ্ধতিকে 'ক্লোজড অপারেশনস সার্ভিস' বলে উল্লেখ করা হয়, যারা কিনা টাকার বিনিময়ে খবর বা কনটেন্ট প্রকাশ করে থাকে এবং যে সূত্র থেকে খবর নেওয়া হয় সেখান থেকেও পাঠকদের দূরে সরিয়ে রাখে।
প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি প্রথম আলোর লেখক মেহরিন নেওয়াজ জানান, 'ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমার প্রচুর লেখা কোনোরকম ক্রেডিট না দিয়েই বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে ছড়াতে দেখেছি। সঠিক মানুষ খুঁজে বের করে তাদের বক্তব্যগুলো সংবাদ আকারে প্রকাশ করা এত সহজ নয়। আমি মনে করি যেখানে প্রাপ্য সেখানে অবশ্যই ক্রেডিট দেওয়া উচিত। এগুলো থেকে যদি আমি টাকা আয় নাও করি, তবু আমার জানা উচিত আমার কাজ কোথায় কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে'।
এসব বিষয় মাথায় রেখেই, তারুণ্যের সংকট এবং তরুণদের জন্য কনটেন্ট বানানোর ব্যাপারে প্রথাগত সংবাদ মাধ্যমে নতুন পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশের তরুণ সাংবাদিকরা উৎসাহ দিয়ে চলেছেন, সেইসাথে করে চলেছেন নিরলস পরিশ্রম।
দ্য ডেইলি স্টারের সাব এডিটর শোয়াইব আহমেদ সায়াম বলেন, 'সাধারণত, যারা প্রথাগত সংবাদমাধ্যম পরিচালনা করেন তাদের তরুণ সমাজের চাহিদা সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকে না। এ কারণে নিউজরুমে বৈচিত্র্য আনা জরুরি, যেন তরুণরা নিজেদের মতো করে তাদের গল্পগুলো বলতে পারে। তরুণদের চাহিদা মেটাতে প্রথাগত সংবাদমাধ্যমগুলোর এক চমৎকার পদক্ষেপ হতে পারে এটি।'
'বাংলাদেশে তরুণদের সংস্কৃতি খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। আমি মনে করি, যা বলা হচ্ছে তা নিয়ে যাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদেরই উচিত ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করা। নিজেদের গল্প অন্য কেউ বলে দেবার চেয়ে প্রথাগত সংবাদ মাধ্যমে নিজেরা বলতে পারলেই বরং তা বেশি কাজে দেয়', আরও যোগ করেন মেহরিন।
আমরা শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখেছি। আমরা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের মিছিল দেখেছি। আরও দেখেছি দেশে-বিদেশে নানান কৃতিত্বের সঙ্গে সুনাম বয়ে আনতে। তবু, গতানুগতিক সংবাদমাধ্যম এখনো তাদের সুরে সুর মেলাতে পারছে না। এর পরিবর্তন আসাটা খুব জরুরি।
এছাড়া আর কী করেই বা তরুণরা দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারবে, বলুন তো?
অনুবাদ করেছেন আনজিলা জেরিন আনজুম
Comments